সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সংসারে এক সম্রাট


তারকাজগৎ
প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ৫:৩০ অপরাহ্ণ / ৯৯
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সংসারে এক সম্রাট

পিছন দিকে চোখ মেলে তাকালেই দেখি – বড়দা বিষয়ক আমার প্রথম স্মৃতি – আমার বড়দা আমাদের বাড়ির পিছনের ফাঁকা মাঠে খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে ফুলের গাছ লাগাচ্ছেন ! ফুলের বাগানে সকাল সন্ধেয় তাঁর অনেকটাই সময় কেটে যায়, আর আমি সেই গোলাপের বিশাল ঝাড়ের ভেতরে টলোমলো পায়ে ঘুরে বেড়াই, উলঙ্গ শিশু । বড়দা নানারকম জৈব সার তৈরি করেন, গোবর, পচা পাতা, খোল এইসব তার উপকরণ । একদিন অনেকগুলো রাক্ষুসে সাইজের নকশা-কাটা বড় বড় টব নিয়ে এলেন, সেগুলোকে রাখা হলো দোতলার বারান্দায়, লাগানো হলো চিত্রবিচিত্রিত পাতাবাহার, কিছু গোলাপও ! … বড়দার ব্যবহৃত সেই খুরপি বহুদিন আমাদের বাড়িতে ছিল, তারপর একদিন ভেঙেচুরে মিলিয়ে গেল মাটিতে ! দু’একটা টবের ভাঙা কানা হয়তো এখনও আমাদের বাড়িতে এককোণে কাত হয়ে পড়ে রয়ে গেছে, দেখলেই আমার শৈশবে বড়দার উপস্থিতির দিনরাত্রি হু হু করে উঠে আসে ।

আর দ্বিতীয় স্মৃতি, তাঁর ছিল একটা হুইল-বসানো ছিপ, সেই ছিপ নিয়ে পুকুরের পাড়ে বসে আছেন সারা দুপুর, মাঝেমধ্যে জলের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছেন ‘চার’ ! এমন সুগন্ধ বেরুতো সেই ‘চার’ থেকে যে মনে হতো একদিন জিভ দিয়ে চেখে দেখব আমি ! তাঁর পাশে বসেই দেখেছি ফাৎনার পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে জলমাকড়সা… ফাৎনার উপরে বসে আছে লম্বা লেজের ফড়িং …! বড়দা একটা ছাতা মাথায় দিয়ে তালগাছের পাশে নিবিষ্টমনে নিশ্চুপ বসে আছেন । পাশে আমি উবু হয়ে উন্মুখ তাকিয়ে আছে, এই ফাৎনা ডুবল বুঝি ! … একবার আমাদের স্কুলের পুকুর থেকে একটা বিশালাকৃতি রুইমাছ ধরে আমার হাতে দিয়ে বললেন, যা বাড়িতে দিয়ে আয় । আমি মহোল্লাসে সেই মাছ দু’হাতে ধরে ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছুটছি বাড়ির দিকে । আশ্বিন মাসে ভরা মাঠ, আমার সমান উচ্চতার ধানগাছ, তার ফাঁক দিয়ে আলপথে ছুটছি , হঠাৎ আঁতকে উঠে থমকে গেছি, সাঁ সাঁ শব্দ তুলে সামনে দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল লম্বা একটা সাপ ! – সেই ভয়, আর সেই মাছ হাতে ছুটে যাওয়ার আনন্দ – পরে আর কখনও পাইনি । জীবনে এই সব আনন্দ, এই সব ভয়, এক-একবারই আসে ।

আর একবার, একটা পুকুরে, একটা খুব বড় মাছ বঁড়শিতে গেঁথে আছে, কিন্তু কিছুতেই তাকে টেনে পাড়ে তোলা যাচ্ছে না । খর খর করে সুতো নেমে যাচ্ছে জলে, একবার বড়দা সেটাকে গুটিয়ে তুলে আনছেন, আবার ছাড়ছেন… হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেলেন জলে ! মাছটা একসময় ধরা দিতে বাধ্য হলো । আমার হাতে মাছটা দিয়ে বললেন, যা বাড়িতে দিয়ে আয়, আর একটা শুকনো কাপড় নিয়ে আয় ! … মাছের চার বানাতে কত কি যে বস্তু লাগত ! গ্রামের একটি লোকের বাড়িতে ছিল ‘বচ’ গাছ । তার কাছে গিয়ে শুধু বলতে হতো, বড়দা পাঠিয়েছে ! সেই লোকটি তার উঠোনে লাগানো বচ গাছ মাটি খুঁড়ে তুলে আনত । শেকড়ে ছোট বাল্বের মতো জিনিসটি অনেকগুলো নিয়ে আসতাম । সেগুলো শুকিয়ে মাটির খোলায় ভেজে নেওয়া হতো। আর লাগত দেশি মদের ‘খাঁড়া’ ! ‘খাঁড়া’ এক অদ্ভুত বস্তু ! কে যেন এনে দিত বড়দাকে । তালপাতায় মোড়া বস্তুটি সম্ভবত গেঁজে ওঠা ভাতের মণ্ড ! এইসব ছিল তাঁর মাছ ধরার উপকরণ। বড়দার সেই ছিপ আজও হয়তো আমাদের বাড়িতে কোথাও রয়ে গেছে ।

এরপর তৃতীয় স্মৃতি, একটা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন বড়দা, আর পাশে দাঁড় করানো গড়গড়া, তার সাপের মতো বাঁকানো নলে ঠোঁটে লাগিয়ে চোখ বুজে তিনি গড়্‌ গড়্‌ শব্দ তুলে যাচ্ছেন ! আমার কাজ ছিলো মাঝেমধ্যে আগুন নিভে এলে দু’একটা বিস্কুটের মতো গোল কালো কালো তামাকের ‘টিকে’ গড়গড়ার উপরে বসিয়ে দেওয়া । বড়দার সেই ইজিচেয়ার ও গড়গড়া জানি না কোথায় আছে ।
আর – বাঁশি ! বাঁশের বাঁশি ! তার গায়ে কালো কালো ছিদ্র । যেখানে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে বাঁশি বাজাতেন বড়দা । নিকষ কালো অন্ধকার গ্রামের ভেতরে একটা মাঠ হ্যাজাগের আলোয় উজ্জ্বল, চাঁদোয়া পড়েছে মধ্যিখানে । সেখানে হবে সিরাজ মাস্টারের আলকাপ ।

আমরা শৈশবে ভাবতাম, আমার দাদা তো স্কুলে পড়ায় না, তাহলে লোকজন কেন “মাস্টার” বলে ডাকে ? তিনি ছিলেন লোকনাট্য ‘আলকাপ’ দলের ওস্তাদ । গুরু । সিরাজ মাস্টারের ছাত্রেরা ছিল স্কুল পালানো কিশোর-তরুণেরা । তারা গাইত, অভিনয় করত, মুখে মুখে তাৎক্ষণিক সংলাপ বানিয়ে স্টেজে হাসির ঝড় তুলত । স্টেজে ওঠার আগে তারা একে একে তাদের মাস্টারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে নেমে পড়ত অভিনয়ে ।
বাড়ি থেকে পালানোর স্বভাব তাঁর ছিলোই, কিন্তু কোথায় শিখলেন গান ? কোথায় শিখলেন বাঁশি বাজানো ? আমরা কখনও তাঁর মুখ থেকে কিছু শুনিনি, জিজ্ঞেসও করিনি । মায়ের মুখে শুনেছি, কর্ডলাইনে নবগ্রাম-জৌগ্রাম স্টেশনের কাছে ছোট্ট গ্রাম ময়না । সেখানে থেকেই গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে পড়তেন দাদা । ময়নায় সাঁওতাল ছেলে কালিয়া-র কাছে তাঁর বাঁশিতে হাতে খড়ি । আমি শুধু বাঁশিটাই দেখেছি । দেখিনি তাঁর বাড়ি পালানো জীবনটাকে । শুধু দেখেছি বড়দা অন্যমনস্ক হাতে কখনও কখনও সেই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া বাঁশিটাকে ছুঁয়ে ফেলছেন ।

আমার স্মৃতি উন্মেষিত হওয়ার আগেই বড়দা সরে এসেছেন ওই লোকনাট্যের জীবন থেকে । অনেক পরে, আমাদের কৈশোরে একদিন একটি লোক তার স্ত্রীকে নিয়ে বড়দার সঙ্গে দেখা করতে এলো । লোকটির নাম আজিজুল । শুনলাম, এই লোকটি বড়দার আলকাপের দলে নারীভূমিকায় অভিনয় করত । যে সব ছেলে আলকাপের দলে মেয়ে সেজে অভিনয় করত, নাচত ও গাইত, তাদেরকে বলা হতো ‘ছোকরা’ । আমার মেজদার তোলা একটা ছবিতে বড়দার সঙ্গে এই ‘ছোকরা’কে দেখা যায় । আজিজুলকে দেখে আমাদের অপার বিস্ময়, এই লোকটি সত্যিকারের লম্বা চুল রেখে মেয়ে সেজে আলকাপ করত? বড়দা বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে সেখানে সৈদাবাদের মাইকেল নামে একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । মাইকেল ছবি আঁকত ও কবিতা লিখত । মাইকেলের আসল নাম ত্রিপুরা বন্দ্যোপাধ্যায় । আমার বাবা সেই মাইকেলের নাম উঠলেই রেগে যেতেন, বলতেন, ওই মাইকেল ছেলেটাই সিরাজকে গোল্লায় দিচ্ছিল। মাইকেল নাকি বড়দাকে সিগারেটসহ নানা রকম নেশায় হাতেখড়ি দিচ্ছিল ! কিন্তু পরিণত বয়সে বড়দা বলেছিলেন, মাইকেলের সঙ্গে আলাপ না হলে আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে তিনি নাকি অজ্ঞই থেকে যেতেন ।

স্থানীয় মানুষজনের ধারণা ছিল সিরাজ নিশ্চয়ই নামজাদা কেউকেটা হবেন একদিন । কেউ ভাবত, সিরাজ একজন নামজাদা বংশীবাদক হবেন । কেউ ভাবত সিরাজ একজন গায়ক হবেন । কেউ কেউ ভাবত, সিরাজ সিনেমায় পার্ট করবেন। খুব অল্প সংখ্যক লোকই ভাবতেন সিরাজ একদিন সাহিত্যিক হবেন । একবার বহরমপুরের বিখ্যাত নকশাল নেতা অনন্ত সেন এসেছেন আমাদের বাড়িতে, আমরা তখন বেশ উঁচু ক্লাশে পড়ি, বড়দাও কলকাতায় লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত । অনন্তবাবু বললেন, বর্ধমান শহরে কমিউনিস্ট পার্টির মিটিংয়ে সিরাজের বাবা এসেছেন । তাঁর সঙ্গে সিরাজ । কতটুকু বাচ্চা ছেলে । বাবার হাত ধরে দশ মাইল পায়ে হেঁটে মিটিংয়ে এসেছে । আমরা ওকে বললাম, তুমি বড় হয়ে বিরাট কমরেড হবে ! এরপর অনন্তবাবু দুঃখ করে বললেন, সেই সিরাজ এখন বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করে!

বড়দার সূত্রেই কয়েকটি স্থাননাম সেই ছেলেবেলাতেই আমাদেরকে আপ্লুত করেছিল, যেমন গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়, ময়না । যেমন মোরেলগঞ্জ, যেমন পানিপারুল, বরশুল ! বড়দা চাকরি নিয়েও কোথাও থিতু হতে পারেনি, তাঁর ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক আজন্ম পলাতক মানুষ, যে কেবল পালাতে চায় কিন্তু জানে না কোথায় সঠিক তার ঠাঁই । এদিকে বাড়িতে এসে গেছেন বড়বৌদি, এখন আর সহজে পালানো মুশকিল । আমরা স্কুলে যেতে শুরু করেছি গ্রামের পাঠশালায়, তখন বড়দার জীবনে আলকাপ দৃশ্যত আর নেই । তখন আমাদের চিরচঞ্চলা বড়বৌদি, হাসিতে গানে নাচে আমাদের বাড়িতে প্রায় বসন্তের কলকাকলি এনে দিয়েছেন । বাড়ির মেয়েরা প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় চুল না ঢেকে হেঁটে যাচ্ছে, বাস ধরে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, এই সব দৃশ্য আমাদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে উঠে ছিল বড়বৌদির কল্যাণে । খোশবাসপুর-গোকর্ণের অর্থডক্স সমাজে সেই সময় হিন্দু সমাজেও মেয়েরা রাস্তায় বেরুতে সংকোচ বোধ করত । আমার মেজদার চোঙওয়ালা গ্রামোফোন তখন সুরের ঝর্না ঝরিয়ে যাচ্ছে – গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু …! ঘরের দরজা বন্ধ করে বড়বৌদি অন্যান্য বৌদিদেরকে নাচ শেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন । আমরা মূঢ় শিশুরা জানলার ফাঁক দিয়ে প্রাণপণে দেখার চেষ্টা করছি ! …বড়বৌদি একহাতে আমার চোয়াল চেপে ধরে অন্যহাতে চিরুনি দিয়ে আমার চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন – সেই অনুভূতিটা এখনও আমার চোয়ালে ও মাথায় লেগে আছে যেন!

হঠাৎ-হঠাৎ পাশের গ্রাম গোকর্ণ থেকে যাত্রাদলের অধিকারী উমাপদ মজুমদার বা মহালন্দী থেকে রাধাশ্যাম নন্দী আসতেন, খোশবাসপুর গ্রামের ডাক্তার চিত্তরঞ্জন সিংহ গান ও নাটক পাগল লোক, বড়দার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব । তাঁরা আসতেন ‘শয়তানের চর’, ‘রাজা দেবীদাস’ -এই সব নামের যাত্রার বই হাতে নিয়ে । বড়দার কাজ ছিল সেই ছাপানো বই পেন দিয়ে কেটেকুটে সম্পাদনা করা । আমার খুব পছন্দ হতো না ব্যাপারটা, ভাবতাম কেন কেটেকুটে ছোট করা হবে, পুরো নাটকটা থাকলে অসুবিধে কী । গ্রামের লোকেদের এইসব আবদার তাঁকে হাসিমুখেই সামলাতে হতো । ধরুন, এক নব্য কবি তার কবিতার খাতা নিয়ে বড়দার কাছে এসে হাজির, “ভুল হলে ঠিক করে দেবেন” – এই সব বায়না । গোকর্ণ লাইব্রেরি থেকে হাতে লেখা পত্রিকা বের করা হবে – বড়দার দায়িত্ব সেই পত্রিকায় ছবি এঁকে দেওয়া । লেখা জোগাড় করা । স্থানীয় মানুষদের এমন অনেক অদ্ভুত আবদার মেটাতে হতো তাঁকে । আর আসত বাউলেরা । তাদের ধারণা হয়েছিল, সিরাজ মাস্টারের সঙ্গে কলকাতার রেডিও স্টেশনের ভালো যোগাযোগ আছে, তাই উনি চাইলেই বাউলদেরকে আকাশবাণীতে প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন ! মনে আছে, একবার কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে । বড়দা কলকাতা থেকে পালিয়ে চলে এসেছেন বাড়িতে । আমাদের গ্রামের পণ্ডিতমশাই ভুজঙ্গভূষণ গোঁসাইয়ের জামাতা এসে বড়দার কাছে জানতে চাইলেন, এখন কলকাতায় ফেরা যাবে কিনা । তিনি কলকাতায় চাকরি করেন, এক মিশ্র জনবসতিতে থাকেন । অনেকদিন অফিস কামাই হচ্ছে তাঁর । শুনলাম বড়দা বলছেন, দেখুন গ্রামে আমরা সবাই সবাইকে চিনি, এখানে আমাদের কোনও ভয় নেই । কিন্তু কলকাতার অবস্থা তো আলাদা, আপনি আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন, অবস্থা শান্ত হলে যাবেন । আমাকেও তো ফিরতে হবে ।

আমাদের সেই সব দিন, যেখানে প্রবল বৃষ্টি ছিল একটানা সাতদিন ধরে, যার নাম ‘ডাওর’ , শীতের ভোরবেলায় ঘাস ভরে থাকত শিশিরের বড় বড় দানায়, যার নাম ‘লিহর , হিজলের তৃণভূমিতে উড়োপাখির ছায়া এসে পড়ত ‘সৈরভী’দের গায়ে – সেই ভূমণ্ডল ও প্রকৃতি হুবহু ধরা পড়ে আছে সিরাজের ছোটগল্পে । তাঁর গল্প পড়তে পড়তে চমকে উঠি, আরে এই হট্টিটি পাখিদের ডাক আমরা শুনেছি সারা শৈশবকাল … ওই তো ঘাসে সঞ্চরমান লাল-নীল পোকা … পাখিদের ঠোঁটে খড়কুটো, তাদের সন্তানের কি জন্মের সময় এসে গেছে ! বড়দার সব লেখার ভেতর থেকেই উঠে আসে হট্টিটি পাখির অতলান্তিক ডাক ! আমরা ছেলেবেলায় বিলে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে হট্টিটি পাখির ঝাঁক দেখেছি, কিন্তু বড়দা না চেনালে আমি চিনতামই না এই পাখিকে ! শেষরাতে হলুদ হয়ে ঝুঁকে থাকা চাঁদ, কিংবা পেট্রোম্যাক্সের আলোয় বিষণ্ণ রাজার হাহাকার –সবই তো তাঁর বিষয়বস্তু । তাঁর নায়িকারা ছিল হিজল অঞ্চলের ডাকাবুকো ‘হিজলকন্যা’ । ছিল মাঠকুড়ুনি, ছিল ঘাসের বনে কাস্তে হাতে স্বৈরিণী । স্বাধীনতার মানে এদের চেয়ে আর কে বেশী জানবে ।

দ্বারকা নদীর বন্যায় সেবার বাসরাস্তা বন্ধ । নৌকা চেপে কিছু পুরুষ মহিলা সেই থই থই বন্যা পেরিয়ে ওপারের গন্তব্যে যেতে চেয়েছিল । নদীর মধ্যিখানে স্রোতের টানে সেই নৌকা ডুবে যায় । সেকালে একটা মৃত্যু হলেই লোকেরা অস্থির হয়ে উঠত । ফলে আমাদের ছেলেবেলায় সেই নৌকাডুবির মর্মান্তিক কাহিনী সারা কান্দী মহকুমার মানুষকে বিচলিত ও ব্যথিত করেছিল । … শীতকালে নদী আবার শুষ্ক । বড়দার পিছন পিছন আমরা চলেছি দ্বারকা নদীর দিকে । দেখছি, জামবনের মাথায় লেগে আছে কোনও হতভাগ্যের কাপড়ের টুকরো …। বড়দার ‘জল সাপ ভালবাসা’ ছোটগল্পে – এমনই এক বন্যায়, একটা গাছকে জড়িয়ে বেঁচে আছে এক পুরুষ, আর উঁচুতে ডালের উপর একজন উলঙ্গ রমণী – আর তাদের মাঝখানে গাছে জড়িয়ে আছে একটি সাপ, সেও এই বন্যায় প্রাণভয়ে এসে গাছে উঠেছে । গ্রামের এক অশিক্ষিত মানুষকে বড়দা অবলীলাক্রমে ‘গুরুজি’ বলে ডাকতেন, বলতেন এ হলো প্রকৃতির পাঠশালার গুরু । এই রকম কয়েকজনের সঙ্গেই একদা পালিয়ে যেতেন স্কুল ছেড়ে ! এই দু’একটা লোকের নাম শুনলেই আমার বাবা খুব রেগে যেতেন, বলতেন, এরাই সিরাজকে নষ্ট করত, লেখাপড়া করতে দিত না ! কিন্তু নদী পেরিয়ে গাভীর চারণভূমিতে, রাখাল-জাগালের পৃথিবীতে, জামবনের মুখরতায়, উলু-কাশের জঙ্গলে বড়দা অনায়াসে সেঁধিয়ে গেছিলেন এইসব নিম্নবর্গীয় মানুষদের হাত ধরে — “নক্ষত্র ভরা আকাশের নিচে প্রসারিত তৃণভূমি, এক প্রজাপতি চলেছে, হঠাৎ দেখতে পায় বুকে হাঁটছে যূথভ্রষ্ট সরীসৃপের মতো খসখসে ঠাণ্ডা রঙীন নীলচক্ষু বিশিষ্ট মানুষ কিংবা মানুষ নয় – তার বুকের তলায় ভাঙা ডিম, ছেঁড়া খোলস, শামুকের খোল, মরা কাঁকড়াবিছের কঙ্কাল, ভিজে ঘাস শ্যাওলা ছত্রাক” (সরীসৃপ প্রজাপতি ইত্যাদি) । এক আদিম অন্ধ জগৎ তাঁর লেখক সত্তাকে তৈরি করে দিচ্ছিল । প্রকৃতির বিশাল বিস্তার পরতে পরতে খুলে যাচ্ছিল তাঁর চোখের সামনে ।

বড়দা জন্মেছিলেন প্রকৃতি প্রদত্ত এই স্বাধীনতাকে কবচকুণ্ডলের মতো সঙ্গে নিয়ে । শৈশব থেকে ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা । ধরাবাঁধা জীবনের ছক টেনে তাঁকে মাপতে গেলে ভুল হবে । সংসারে থাকলেও সংসারের মালিন্য ও যাপনের নৈমিত্তিক অভ্যাস তাঁকে ছুঁতো না । অনেক লোকের ভিড়েও তাঁকে আলাদা করে চেনা যেত । কিন্তু জনসমাগমে, যেমন কোনও পড়শির জন্মদিনে বা কারুর বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না । শুধু ছোট একটি পরিমণ্ডলে ঘনিষ্ঠজনের সান্নিধ্যে কথা বলতে ভালবাসতেন । বহু অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে শেষপর্যন্ত তাঁর যাওয়া হতো না ।
বড়দাকে কি বলা যাবে – সংসারে এক সন্ন্যাসী?
কক্ষণও না ।
তিনি ছিলেন সংসারে এক সম্রাট ।

আমরা শৈশবে দেখেছি, বড়দা চেয়ারে খাড়া হয়ে বসে আছেন, আর তাঁর পায়ের কাছে গ্রামের মানুষেরা ভিড় করে বসে আছে, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর কথা শুনছে ।
কলকাতায় বা লেখালেখির জগতেও আপোষ করতে শেখেন নি কখনও । কোনও বিখ্যাত প্রকাশকের সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি অবলীলাক্রমে নিজের বই তুলে নিয়ে অন্য কোনও ছোট প্রকাশককে দিতে পেরেছেন । কোনও কোনও বিখ্যাত সম্পাদকের চাটুকারিতা করেন নি বলে অনেক ফল ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে । কিন্তু তিনি এই সব ঘটনাকে তুচ্ছ বলেই ভাবতেন ।
অসম্ভব ধরনের আত্মসম্মানবোধ ছিলো তাঁর । তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তাতে প্রায় অটল ছিলেন বলা যায় । যদি কিছুকে অন্যায় বা ভুল বলে মনে করেন, তাহলে কখনও কারুর কাছে অবনত হতে রাজি ছিলেন না । সহস্র লোকের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে অপ্রিয় হতেও আপত্তি ছিল না তাঁর । তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাবার কাছ থেকেই পাওয়া বলে মনে হয় ।

বাবা ছিলেন খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ । আর বড়দা তাঁকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে স্কুল পালাতেন, গল্পের বই পড়তেন । অমন কড়া পিতার চোখের আড়ালে প্রকৃতির পাঠশালায় পড়াশুনা শুরু করেছিলেন, আমরা ভাবলেই বিস্মিত হই । বাবার খুব আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাঁর বড় ছেলে লেখাপড়া করে অধ্যাপক হবে । কলেজে পড়ানোর ব্যাপারটা আমার বাবার বড় প্রিয় পেশা ছিল । কিন্তু তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র তাঁর ইচ্ছায় জলাঞ্জলি দিয়ে পলাতক বালকের জীবনযাপন করছে, এটা তাঁকে বরাবর পীড়া দিত । আমার বাবাও তথাকথিত সংসারী মানুষ ছিলেন না । না হলে, একদল নাবালক পুত্রকে বাড়িতে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন না অথবা ব্রিটিশের জেলেও যেতেন না ।
বড়দা তখন লিখতে শুরু করেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ! আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দ্বারকা নদী, দ্বারকার অববাহিকায় উলু-কাশ-নলখাগড়ার জঙ্গল, ঘাসের বন, খাল-বিল-কাঁদর ভেদ করে ডাকাবুকো মানুষেরা ঘর বাঁধে । সেইসব মানুষেরা তাঁর বিষয়বস্তু । কান্দী থানার অন্তর্গত একটি অঞ্চলের নাম হিজল । বড়দার লেখা একটা গল্প ‘হিজল বিলের রাখালেরা’ – ছাপা হয়েছে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় – একদিন সন্ধেবেলা বাড়ির সামনে পঞ্চাশ জন লোক ভিড় করে স্তব্ধ হয়ে শুনল সেই গল্প । পাঠ করছিলেন অন্য এক দাদা । নিরক্ষর বা স্বল্পসাক্ষর মানুষেরা অভিভূত হয়ে শুনছে তাদেরই জীবনের গল্প, এই দৃশ্য আমি কক্ষণও ভুলব না ।

সেইসময় বড়দা একটা ঢাউস রেডিও কিনলেন । বাড়ির সামনের নিমগাছে ও অন্যদিকে উঁচু বেলগাছের ডালে লাঠি বেঁধে – একটা খুব লম্বা এরিয়ালের তার টাঙানো হলো । সেই রেডিও শুনতে রোজ গ্রামের মানুষেরা ভিড় করে এসে বসে থাকত বাড়ির সামনে ঘাসের উপর । আমাদের জীবনেও আস্তে আস্তে প্রবেশ করছে গ্রামের বাইরে থেকে উঠে আসা অন্য বাতাস ।
এর মধ্যেই বড়দার লেখা দুটি গল্প – ‘ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু’ এবং ‘ভালবাসা ও ডাউনট্রেন’ প্রায় আলোড়ন তুলে দিয়েছিল বলা যায় । আমরা নেহাতই অপোগণ্ড বালক, কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকায় গল্পদুটির প্রশংসার উচ্ছ্বাস ও বিভিন্ন মানুষের চিঠিপত্র – আমাদেরকেও নাড়া দিয়ে গেল । রাস্তায় ডাকপিওন হঠাৎ থেমে আমার হাতে বড়দার নামে কোনও মোটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল । আমি নাচতে নাচতে বাড়ির দিকে দৌড়ুচ্ছি, নির্ঘাত কোনও পত্রিকা আছে যাতে বড়দার লেখা ছাপা হয়েছে । বড়দার নামে মানি অর্ডারে টাকা পয়সাও আসতে দেখেছি সেই সময় ।

বড়দার লেখা প্রথম উপন্যাস কিংবদন্তীর নায়ক – যেটা প্রকাশিত হয়েছে অন্যান্য বইয়ের পরে –সেটার নাম প্রথমে ভাবা হয়েছিল চণ্ডালিকার মাঠ। একটু একটু করে লেখা হচ্ছিল গ্রামের বাড়িতেই ।
আমি এখনও চোখ না বুঁজেই দেখতে পাই, বড়দা দোতলায় দক্ষিণের ঘরে মেঝেতে আসনপিঁড়ি দিয়ে বসে মাথাটা একটু নামিয়ে নিবিষ্টমনে লিখে যাচ্ছেন, বাঁ হাতটা মাটির উপরে রাখা । আমি পাশে বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি । হঠাৎ আমার দিকে মুখ তুলে বললেন, যা তো এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয় ! আমি প্রায় ধন্য হয়ে সিগারেট কিনতে ছুটলাম দোকানে ।
দেশ ও পরিচয় পত্রিকায় কবিতা ছাপা হওয়ার পরে আর কবিতায় মন দেননি । লিখতে শুরু করেছেন গল্প । সেই সময় “অমৃত” নামে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক পত্রিকাটির খ্যাতি ছিল সীমাহীন । এই পত্রিকাতেই তাঁর সবচেয়ে বেশি গল্প ছাপা হয়েছে । ভারত চীনের যুদ্ধের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা তাঁর ‘সীমান্ত থেকে ফেরা’ অমৃত পত্রিকায় ছাপা হতেই চারদিকে প্রশংসিত হতে থাকল ।
একদিন দেখলাম, বহরমপুর থেকে এক ভদ্রলোক এলেন বড়দার কাছে, অনেক আড্ডা মেরে চলে গেলেন । শুনলাম এঁর নাম অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় । থাকেন বহরমপুরের কাছে বানজেটিয়া কলোনিতে।
ভারি মজার ব্যাপার, সেই সময়ে হাংরি জেনারেশানের নাম আমরা শুনে গেছি বড়দার দৌলতে । হাংরিদের চটি চটি পুস্তিকায় বড়দার নামের উল্লেখ থাকত । বহুদিন পরে কফিহাউসে সুবিমল বসাক আমাকে বলেছিলেন, সিরাজ আমাদের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু !

বড়দা একসময় পাকাপাকি ভাবে আমাদের খোশবাসপুর গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন ঠিক হলো, কেন না কলকাতায় ভাণ্ডার নামে একটি পত্রিকায় চাকরি পেয়েছেন । কলকাতায় প্রথমে বসবাসের সংস্থান করতে না পেরে হুগলির পাণ্ডুয়া নামে একটি জায়গায় সপরিবারে উঠলেন, আর ওখান থেকে কলকাতায় ডেলি প্যাসেঞ্জার হয়ে যাতায়াত করছিলেন ।
একদিন সন্ধেবেলায় সাইকেল রিকশায় বাক্সপ্যাঁটরা বিছানাবালিশ গুছিয়ে বড়দা ও আমার এক দাদা চললেন ২০ কিলোমিটার দূরের খাগড়াঘাট স্টেশনে । রাত্রি ১১টায় হাওড়ার ট্রেন ধরে ওঁরা পাণ্ডুয়াতে নামবেন । আমরা সবাই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম বাড়ির সামনে । ১৯৬৪ সাল ! …
সেই বড়দা আবার ফিরে এলেন নিজের গ্রামে প্রায় অর্ধ শতক পরে নগর সভ্যতার বাঁধন ছিন্ন করে; যে মাটিতে তাঁর পিতৃপুরুষ ঘুমিয়ে আছে, যেখানে ঘাসবন… হট্টিটি পাখির ডাক… লাল নীল পোকাদের সঞ্চরণ … প্রিয় দ্বারকা নদী, সেই আলো ও ছায়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকার জন্য ।

আজ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্মদিনে তাঁর ছোটো ভাই জামিল সৈয়দের স্মৃতিচারণ
(সংকলিত)

Spread the love
Link Copied !!