মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ১৯ হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত করার পেছনে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল তিনি ছিলেন সেই উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের একজন তিনি।

২০১৫ সালে তাকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়ার ঘোষণা দিলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘রাজনীতির অর্থ দেশ এবং মানুষের সেবা। পদ বা পদবির জন্য কখনো রাজনীতি করিনি। পদক দিলে বা নিলেই যে মানুষ সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম, কোনো পদক বা পদ-পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশায় যাননি।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে মন্ত্রীত্বের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। সেটিও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ নীতির প্রশ্নে আজন্ম অটল এক যোদ্ধা। যিনি কেবল দিয়েই গেছেন, বিনিময়ে কিছু পাওয়ার অপেক্ষাটুকুও করেননি।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবীদ্বারের এলাহাবাদ গ্রামে।

বাবা কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন স্কুলশিক্ষক। আর মা আফজারুন্নেছা। বাবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়েই তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল। হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক শেষে, দেবিদ্বার রেয়াজ উদ্দিন পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করার পর শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র মোজাফফর আহমদের। দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। তার আজিমপুরের ৮/আই কলোনির বাসায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত বাম নেতাদের বৈঠক হতো।

সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। দুই বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। মোজাফফর আহমদের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিলো ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময়।

১৯৫৪ সালে শিক্ষকতা ছাড়ার পর যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়েই মোজাফফর আহমদ কুমিল্লার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থী শিক্ষামন্ত্রীকে নির্বাচনে হারিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ এর প্রতিনিধি নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন প্রথম।

তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, সেটি আমাদের নেতা মওলানা ভাসানীর একক কিংবা কোনো একটি দলের দাবি নয়। এটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষের দাবি। এটি আবেগের কিংবা ভোট লাভের স্লোগান নয়। এটি হলো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত এ অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা।’

অথচ আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাবের সমালোচনা করে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কি একেবারেই স্বাধীনতা চান?’ আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতার বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি মুজিবুর রহমান দেশের ৬ কোটি মানুষের কাছে যে ওয়াদা করেছি তা থেকে এক ইঞ্চি হটতে, নড়চড় করতে পারব না। আমার গলায় যদি কেউ ছুরিও চালায় তাতেও আমাকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরাতে পারবে না।’

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করেছিল। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা‌ও করেছিল। এরপর আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। আত্মগোপন থাকা অবস্থাতেই তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেছিলেন।

ছদ্মবেশে কখনো ফেরিওয়ালা, কখনো তরকারি বিক্রেতা কখনো ফল বিক্রেতার রূপে তিনি বের হয়ে আন্দোলনে সংযুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ফের ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে এলেন মোজাফফর আহমদ। ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুরে এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যখন চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী-এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়লো চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। সেই দলে মওলানা ভাসানী ছাড়াও ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো। আর মস্কোপন্থী শিবিরে পূর্ব পাকিস্তান পন্থী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।

১৯৬৯ এর ২৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যখন হরতাল পালিত হয়েছিল, ঢাকায় আইয়ুব খানের সামরিক সরকার জারি করে কারফিউ এই অবস্থাতেই ২৯ জানুয়ারি ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

গণ-আন্দোলনের চাপে আইয়ুব খানের সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব অভিযুক্তকে ও রাজবন্দিদের মুক্তি দিয়ে গণদাবির কাছে পরাজিত হয়ে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করতে বাধ্য হন। মার্চে অনুষ্ঠিত সেই গোলটেবিল বৈঠকে ন্যাপের প্রতিনিধি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। উপদেষ্টা কমিটির বাকি সদস্যরা ছিলেন মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ১৯ হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত করার পেছনে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে মোজাফফর আহমদ নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। সে সময়ে উত্তর আমেরিকা প্রবাসী পাকিস্তানিদের সাময়িকী ‘পাকিস্তান ফোরামকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের সংগ্রাম যেখানে শেষ হবে, সেখান থেকেই বামপন্থীদের সংগ্রাম শুরু হবে।’ যদিও তা বাস্তবে হয়নি।

তাকে প্রশ্নকর্তা যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করছিলেন, মোজাফফর আহমদ বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘সেটি আপনার ধারণা হতে পারে। আসলে আমার কীই-বা অবদান? দেশের জনগণের আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামে নিজের অবদানকে অতি শ্রেয় ভাবা ঠিক নয়।’

মুক্তিযুদ্ধের পর মোজাফফর আহমদই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের দুই দিন পর যশোরে অনুষ্ঠিত জনসভায় ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছিলেন, ‘নবলব্ধ স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের একক সরকার গঠন করা ঠিক হবে না। এখন দেশপ্রেমিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং জাতীয় স্বাধীনতাকে সব হামলা এবং চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার স্বার্থে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য সম্মিলিত হওয়া দরকার। না হলে স্বাধীনতার ওপর কোনো বিপদ এলে এককভাবে কোনো দল প্রতিহত করতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, সম্মুখযুদ্ধে একটি দেশের হানাদার বাহিনী শুধু পরাজিত হয়েছে কিন্তু দেশের ভেতরে প্রতিবিপ্লবীদের চক্রান্তে সাম্রাজ্যবাদী সামন্তবাদী বহিঃশত্রুর মদদদান বন্ধ হয়নি। তারা নতুন করে চক্রান্ত আঁটছে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া এ চক্রান্ত মোকাবিলা করা যাবে না।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার যখন তাকে মন্ত্রীত্বের প্রস্তাবও দিয়েছিলো তখন সবিনয়ে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

রাজনীতিই ছিল অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের শুরু আর শেষ। যে রাজনীতির সুযোগ নিয়ে নিজের ভাগ বাটোয়ারা আর নিজের হিসেব বুঝে নিতে দ্বিধাবোধ করে না কেউ সেখানে মোজাফফর আহমদের মতো মানুষ ব্যতিক্রম। প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম এ ব্যক্তিত্ব নিজেকে সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবেসেছেন আজীবন।

ব্যক্তিজীবনে তিনি কথা বলতেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে, কখনো তাতে থাকতো প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালির ছোঁয়া। প্রায়ই বলতেন, ‘আমার নাম মোজাফফর আহমদে নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি’।

সরল ও সাহসী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আজীবন রাজনীতিকে অবলম্বন করে নিজের সমস্ত অধিকার বিলিয়ে দিয়েছেন গণমানুষের মাঝে। মদনপুরে তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উপমহাদেশের একমাত্র শিক্ষায়তন সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ। দেশের বাম আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এই ব্যক্তিত্ব বারেবারে এগিয়ে এসেছেন মানুষের গণ অধিকারের দাবিতে, নিজের জীবনের সুবর্ণ সময়েও গণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। জানতেন এই পথ ভীষণ দুর্গম। কিন্তু আমৃত্যু স্রোতের প্রতিকূলে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস ছিল তার। (সংকলিত)