আইনি পদক্ষেপ নেন না ৮৮% ভুক্তভোগী


টি আই শাহীন
প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২, ১২:০১ অপরাহ্ণ / ১০১
আইনি পদক্ষেপ নেন না ৮৮% ভুক্তভোগী

ভুক্তভোগীরা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে আইডি বন্ধ বা আধেয় ডিলিট করতেই বেশি আগ্রহী।

অনলাইনে ছোট্ট পরিসরে ব্যবসা করেন সমাপ্তি (ছদ্মনাম)। চলতি বছরের এপ্রিলে ফেসবুকের দুটি ভুয়া আইডি থেকে তাঁকে নিয়ে আপত্তিকর বার্তা পাঠায় স্বজনদের কাছে। কখনো ফুপাতো ভাই, কখনো মামা সেজে সমাপ্তির স্বামী, বোন, মা ও চাচিকে আপত্তিকর নানা বার্তা তাঁদের ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠাতে থাকে।

পরে সমাপ্তি কোনো উপায় না পেয়ে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) ইউনিটে অভিযোগ দেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, অভিযুক্ত ব্যক্তি সমাপ্তির আপন চাচাতো বোনের স্বামী। বোনের সংসারের কথা চিন্তা করে তিনি পারিবারিকভাবে বিষয়টি মীমাংসা করেন।

অনলাইনে হয়রানির শিকার হলেও সমাপ্তির মতো আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না অধিকাংশ ভুক্তভোগী নারী। পিসিএসডব্লিউতে আসা ২২ মাসের (নভেম্বর ২০২০ থেকে আগস্ট ২০২২) তথ্য-উপাত্ত বলছে, ভুক্তভোগী নারীদের মাত্র ১২ শতাংশ মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

অর্থাৎ ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। এমনকি ৩২ শতাংশ ভুক্তভোগী পিসিএসডব্লিউর কর্মকর্তাদের কাছে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জানাতেও অস্বীকৃতি জানান। ভুক্তভোগীরা আইনিব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি বন্ধ বা আধেয় (কনটেন্ট) মুছে ফেলতেই বেশি আগ্রহী।

এর কারণ হিসেবে ভুক্তভোগী অনেকে পিসিএসডব্লিউর কর্মকর্তাদের বলছেন, পরিবারকে জানাতে না চাওয়া ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে তাঁরা বিষয়টি গোপন রাখতে চান। অনেক অভিযুক্তের সঙ্গে ভুক্তভোগীর পারিবারিক বন্ধনও থাকে। আবার পরবর্তী সময়ে হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায়ও অনেকে ওই পথে যেতে চান না।

পিসিএসডব্লিউ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর। যাত্রা শুরুর পর থেকে গত প্রায় ২২ মাসে অনলাইনে হয়রানির শিকার ২০ হাজার ১৫৬ নারী সেখান থেকে সহায়তা পেয়েছেন।

পিসিএসডব্লিউতে অভিযোগকারী নারীদের ৪৪ শতাংশের অভিযোগ, ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে তাঁদের আপত্তিকর ছবি, ভিডিও বা তথ্য ছড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। ফেসবুক আইডি হ্যাক করে আপত্তিকর ছবি ও তথ্য ছড়িয়ে হয়রানি করার অভিযোগ ১২ শতাংশের। আপত্তিকর ছবি, ভিডিও বা তথ্য ইন্টারনেটে ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করার অভিযোগ ১৭ শতাংশ নারীর।

পুলিশ সদর দপ্তরের আড়ি পাতা (এলআইসি) শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মীর আবু তৌহিদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের যেকোনো জায়গা থেকে পিসিএসডব্লিউতে অভিযোগ দেওয়া যায়। অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার সত্যতা যাচাই করা হয়। তথ্যপ্রমাণ পেলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা আইনি প্রতিকার চান না। এ কারণে অনেক সময় ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার ১৭ শতাংশ

চলতি বছরের ২৫ মে সিলেটের এমসি কলেজের নতুন ছাত্রীনিবাস থেকে এক ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, ওই ছাত্রীর বন্ধুর মুঠোফোন থেকে আপত্তিকর ছবি নিজের মুঠোফোনে নিয়ে ব্ল্যাকমেলিং করছিল এক তরুণ। এভাবে ওই ছাত্রীর কাছ থেকে কয়েক দফা অর্থও হাতিয়ে নেওয়া হয়। বারবার টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেলিংয়ের একপর্যায়ে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।

পিসিএসডব্লিউ বলছে, অভিযোগকারীদের একটি বড় অংশই (১৭ শতাংশ) ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। পূর্বপরিচয় বা অন্য কোনোভাবে পাওয়া ছবি, ভিডিও পাঠিয়ে টাকা দাবি করে অনেক অপরাধী। আবার অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতেও অনেককে ব্ল্যাকমেল করা হয়।

পুলিশ কর্মকর্তা মীর আবু তৌহিদ বলেন, নারীরা বেশি হয়রানির শিকার হন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপনের পর। কথোপকথনের মাধ্যমে ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে অপরাধী ব্ল্যাকমেল করেন।

অপ্রাপ্ত বয়সীরাও ভুক্তভোগী

ঢাকার বাসাবোতে গত বছরের জুনে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অপমান সইতে না পেরে ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করে। পিসিএসডব্লিউর তথ্য বলছে, অভিযোগকারী ভুক্তভোগীর ১৬ শতাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আর ৫৮ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। ২০ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ ভুক্তভোগীদের ৯৪ শতাংশের বয়সই ৩০ বছরের মধ্যে।

ঢাকার তেজগাঁওয়ের একটি কলেজের ভুক্তভোগী এক ছাত্রীর বড় বোন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা দুই বোন ঢাকায় লেখাপড়া করেন। তাঁর ছোট বোনের সঙ্গে এক তরুণের সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই তরুণ ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও করে তাঁর ছোট বোনকে দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেল করছে। তাঁরা বিষয়টি পুলিশকে জানালেও সামাজিক মর্যাদার ভয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না। ছোট বোনকে অভিযুক্ত তরুণের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাঁরা সমস্যার সমাধান করতে চান।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২২’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে যাঁরা অনলাইন অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি হয়রানি ও পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছেন। ৭৬ শতাংশ ভুক্তভোগী নারী আইনি সহায়তা নিতে চান না।

সিসিএ ফাউন্ডেশনের ওই গবেষণা দলের প্রধান ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মনিরা নাজমী জাহান প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে নারীদের একটি বড় অংশই পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন। তাঁদের মধ্যে নিকটাত্মীয়ও থাকেন। অনেক সময় অভিযুক্তকে দোষারোপ না করে ভুক্তভোগীকেই দোষ দেওয়া হয়। আবার ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই বয়সে কিশোরী ও তরুণী। তারা বিষয়গুলো বাবা-মাকেও জানাতে চান না। কখনো দেখা যায়, অভিযুক্তরা প্রভাবশালী। সামাজিক মর্যাদা ও ভবিষ্যতে হয়রানির ভয়ও আছে নারীদের। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না।

দুর্বিষহ জীবন

চৈতি ও ইমনের (দুজনের ছদ্মনাম) বিয়ের এক সপ্তাহ আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সম্পাদনা (এডিট) করা তাঁর আপত্তিকর ছবি। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের মুঠোফোনেও ছড়িয়ে দেওয়া হয় এসব ছবি। এতে ভেঙে যায় চৈতি-ইমনের বিয়ে। অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন চৈতি। ইমনের পরামর্শে চৈতি পিসিএসডব্লিইউতে অভিযোগ দেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ইমনের সাবেক প্রেমিকা তৃতীয় একজনকে দিয়ে ওই অপপ্রচার চালিয়েছেন।

চৈতির মতোই আরেক ভুক্তভোগী রূপসী (ছদ্মনাম)। ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর নামে আপত্তিকর ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসব ছবি রূপসীর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছেও পাঠানো হচ্ছিল। এতে করে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে রূপসীর সম্পর্কের অবনতি হয়। পরে তাঁর অভিযোগের প্রযুক্তিগত তদন্তে বেরিয়ে আসে, এক নারী ভুয়া আইডি খুলে ওই অপপ্রচার চালাচ্ছিলেন। ওই নারীকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেল, তাঁর স্বামীর সঙ্গে রূপসীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ কারণে তিনি রূপসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলছিলেন।

পিসিএসডব্লিউর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খালেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তুচ্ছ কারণে নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে অপপ্রচার চালানো হলে তাঁরা ভেঙে পড়েন। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অনেক নারীকেই চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এ কারণে কোনো ভুক্তভোগী তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তাঁকে প্রথমে কাউন্সেলিং করা হয়। পরে তাঁকে সংশ্লিষ্ট থানার নারী ও শিশু ডেস্কের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেওয়া হয়।

প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও আসছে অভিযোগ

পিসিএসডব্লিউতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও অভিযোগ আসে। ভুক্তভোগীর অবস্থান যেখানেই হোক হটলাইন (০১৩২০০০০৮৮৮), ই–মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক পেজের মেসেঞ্জারের মাধ্যমে তাঁরা পিসিএসডব্লিউতে অভিযোগ জানাতে পারেন।

প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ঘটনার উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, এক তরুণীর পরিবারের সঙ্গে প্রতিবেশীদের জমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিল। এ ঘটনার কিছুদিন পরই ওই তরুণীর নামে ফেসবুকে একটি ভুয়া আইডি খুলে আপত্তিকর ভিডিও ও ছবি ছড়ানো হয়। পরে তদন্তে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনা হয়।

ওই ২২ মাসের অভিযোগ পর্যালোচনা করে পিসিএসডব্লিউ জানায়, ঢাকা বিভাগ থেকে ৬৪ শতাংশ ও চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ দিয়েছেন। এর বাইরে খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ করে, বরিশাল বিভাগ থেকে ৩ শতাংশ এবং রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে ২ শতাংশ করে অভিযোগ এসেছে।

(সংগৃহীত)

Spread the love
Link Copied !!