নদীখেকোদের কবলে অস্তিত্ব সংকটে তুরাগ নদী


রেজোয়ান আহমেদ সংগীত
প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৫, ২০২২, ১১:৫৮ অপরাহ্ণ / ১০৪
নদীখেকোদের কবলে অস্তিত্ব সংকটে তুরাগ নদী
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। রাজধানীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের বিরাট এক অংশ এ তুরাগ নদী। বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীর উৎযাপিত বিরাট ইসলামী আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান “বিশ্ব ইজতেমা” তুরাগ নদীর টঙ্গী এলাকার তীর ঘেষেই অনুষ্ঠিত হয়। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই নদীর নাম ও তাৎপর্যও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুই তীর ঘেঁষে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদার, নাব্যতা সংকট, মাত্রাতিরিক্ত দূষণ আর কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতায় এই ঐতিহ্যবাহী ও তাৎপর্যপূর্ণ নদীটির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন ও চরম সংকটাপন্ন।

বালু ব্যবসায়ীদের অবৈধ দখল ও নদটি থেকে অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি কেটে বিক্রি করায় চরম হুমকির মুখে পড়েছে নদী তীরবর্তী জনবসতির বিরাট অঞ্চল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তারাও রয়েছেন দখলদারের লম্বা তালিকায়। নদীটি খননের নামে অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে মাটি।

রাজধানীর মিরপুর-মোহাম্মদপুর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত নদীর দুইপাশ জুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। দখল-ভরাট আর দূষণে তুরাগ নদের প্রস্থ আশংকাজনক হারে কমছে। ফলে এককালের প্রমত্তা তুরাগ নদীটির কোথাও কোথাও সরু খালেও পরিণত হয়ে গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মিরপুর এলাকার দিয়াবাড়ী, কাউন্দিয়া, বড়বাজার, তুরাগ সিটি, নবাবেরবাগ, গোড়ান চটবাড়ী অঞ্চলে প্রভাবশালী মহল নদটির দুই তীর অবৈধভাবে দখল করে ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

 

বিভিন্ন স্থাপনা, রেষ্টুরেন্ট, বসতিসহ ৪৩ টি অবৈধ বালু মহলের কারনে পরিবেশের দূষনের মাত্রা অসহনীয় মাত্রায় পৌছেছে। সামান্য বাতাস বইলেই পুরো অঞ্চলটিতে বয়ে যায় বালু বৃষ্টি। প্রচুর বালু বসতবাড়িতে ঢুকে মূল্যবান আসবাবপত্র বিনষ্টসহ বাড়িঘরের পরিবেশ দূষিত করছে।

 

মিরপুর বেড়িবাঁধের চটবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদের পাড়ে গড়ে উঠেছে নেবারল্যান্ড পার্ক। নদের সীমানা পিলার পড়েছে ওই পার্কের ভেতরেই। এরই পাশ দিয়ে কোনো রকমে বয়ে যাচ্ছে মৃতপ্রায় তুরাগের পানি। এর পাশে একইভাবে নদীর বিরাট অঞ্চল দখল করে গড়ে উঠেছে তামান্না ফ্যামিলি ওয়ার্ল্ড নামের আরেকটি পার্ক। নকশা অনুযায়ী সেটারও পুরোটাই নদের ভেতরে পড়েছে। এর পাশেই রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হোটেল-রেষ্টুরেন্ট।

 

তবে তুরাগ দখলে শীর্ষে রয়েছে এনডিই রেডিমিক্স, ক্রাউন সিমেন্ট রেডিমিক্স কারখানা, তুরাগ রিক্রিয়েশন ওয়ার্ল্ড, রেজা কনস্ট্রাকশন, সোনার বাংলা স্টোন ক্রাশার, শারফিন ট্রেডিং সিন্ডিকেট, মির্জা মৎস্য খামার, ডোমইনো, জারা নিট কম্পোজিট, সিমরান কম্পোজিটসহ বেশ কিছু বড় প্রতিষ্ঠান। যারা তুরাগের বিরাট এক অংশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কথিত সমবায় সমিতি, ছোট মার্কেট, মাছের খামার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কিছু অংশও রয়েছে। এগুলোও মূল সড়ক থেকে নদের দিকে এগিয়ে নদীর ভূমি দখল করে স্থাপন করা হয়েছে।

 

এসব জায়গা আগে জলাশয় ছিল বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। মিরপুর এলাকায় বেড়িবাঁধের সিন্নিরটেক থেকে শুরু করে আশুলিয়া পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটারের মধ্যে তুরাগের পাড়ে কয়েকশ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দিয়াবাড়ী এলাকায় তুরাগের পাড় ঘেঁষে রাখা হয়েছে বালু। নদীতে ভেড়ানো কার্গো থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বালু এনে পাড়ে ফেলা হচ্ছে। সেই বালু এক্সকাভেটর দিয়ে কেটে ট্রাকে তুলে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

 

এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, একটি প্রভাবশালী মহল অবৈধ ও অপরিকল্পিত ভাবে নদীটি থেকে বালু উত্তোলন করায় আশ পাশের তীরবর্তী জনবসতির বিরাট অংশ চরম হুমকীর মুখে পড়েছে। বিভিন্ন ভাসমান হোটেল, রেষ্টুরেন্ট খুলে নানা অপকর্ম করছে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট।

 

বেড়িবাঁধের নিত্যনৈমত্তিক সড়ক দুর্ঘটনাও আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারন হিসেবে বালু ব্যবসায়ীদের বালু মহলগুলোই মূলত দায়ী। সামান্য বাতাসেই বালু উড়ে চলন্ত যানবাহনের চালকদের চোখে-মুখে পড়ে নিত্যদিন ঘটছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। মাঝে মাঝে কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও কয়েকদিন পর “যেই লাউ সেই কদু” অবস্থা হয়ে যায়।

এলাবাসীর দাবী-এই নদীতে প্রতিদিন অসংখ্য নৌযান চলাচল করে। কাউন্দিয়া ইউনিয়নের বিপুল সংখ্যক মানুষ মিরপুরের সাথে যোগাযোগ রাখতে নদী পারাপারে কয়েক শত নৌকাও ব্যবহার করে। যেসব স্থানে বালু ফেলা হচ্ছে, সেগুলো ছিল নিচু জলাশয়। এভাবে বালু ব্যবসার কারণেও নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। কর্তৃপক্ষ একটু সু-দৃষ্টিসহ নদীটির স্বাভাবিক অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়োজনীয় খনন, পরিবেশকে অসহনীয় মাত্রার দূষণ হতে রক্ষা, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন রোধ করে নদীটির স্বাভাবিক রূপদান করতে সক্রিয় হোক। তীরবর্তী দুই পাশের বিরাট জনবসতিকে আশংকাজনক হুমকির হাত থেকে রক্ষা করবে।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যমতে, তুরাগে ১৫২টি সীমানা পিলারের মধ্যে ৯০টিই অবৈধ দখলের কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বাপা ও নদী রক্ষা আন্দোলনের করা যৌথ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তুরাগের দখল হওয়া জমির পরিমাণ এক হাজার ৩৯৮ একর। অথচ সরেজমিন তুরাগ তীরে গিয়ে দখলদারদের সঙ্গে আলাপের সময় বেশিরভাগই দাবি করেন, এগুলো তাদের কেনা সম্পত্তি।

 

তবে দখলকারীদের অনেকেই এগুলোকে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি বলে দাবি করলেও ড্যাপ অনুযায়ী প্লাবনভূমি সংরক্ষণের যে নির্দেশনা রয়েছে তা অনুসরণ করা হলে তুরাগ তীরে কারো পৈতৃক কিংবা ক্রয়সূত্রে জমি থাকলেও সেখানে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকার দুই পাশ জুড়েই রয়েছে অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জমি। বিআইডব্লিউটিএর জমি ছাড়াও এক সময় তুরাগ তীরে কৃষকদের কিছু জমিজমা ছিল, যেসব জমিতে ধানসহ অন্য ফসলের চাষও হতো। ফসলি ওইসব জমি কিনে নিয়ে এবং কেনা অংশের পাশ থেকে বিআইডব্লিউটিএর জমি ইজারা নিয়ে বা দখল করে শিল্প-কারখানা ও পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রাইভেটকার থেকে বের হলো ৫ মৃতদেহ

দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র একজন উর্ধতন কর্মকর্তা  বলেছেন, নদী-খাল দখল করে পানির গতিপথ রোধ করা রাজধানীর জন্যে এক বিরাট হুমকী সরূপ। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার ভেতরে ও আশপাশের দখল হয়ে যাওয়া খাল-নদীগুলো পুনরুদ্ধার করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরই মধ্যে নদীর দুই পাশের বহু স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নদী রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। স্থায়ীভাবে দখলমুক্ত করা না গেলে কালের পরিক্রমায় তুরাগ বিলীন হয়ে যাবে। সে উদ্দেশ্যেই অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Spread the love
Link Copied !!