দুইদিন….মায়াবী নিউইয়র্কে


বন্ধন টিভি ডেস্ক
প্রকাশের সময় : আগস্ট ৩, ২০২২, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ / ৪৮
দুইদিন….মায়াবী নিউইয়র্কে

দুইদিন….মায়াবী নিউইয়র্কে। বিশ্বের অন্যতম মহানগর নিউইয়র্ক দেখার সুযোগ বারে বারে আসেনা। যদিও ১৮০০০ বর্গমাইল জুড়ে অন্টারিও লেকের এপারে, কানাডার অন্যতম মহানগর টরন্টো। আর ওপারে নিউইয়র্ক । বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণ নায়াগ্রা ফল। অতিক্রম করলে নিউইয়র্কেও বাফেলো।

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যকার বন্ধুত্বের নিদর্শন নায়াগ্রা ফলসের ওপরে সেতু আছে । এর নাম‘ মৈত্রী সেতু ’। দেখলে মুগ্ধ হতেই হবে । জলপ্রপাতের অবিরাম ধারা দুই দেশের মানুষ শুধু নয় বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখতে আসে গ্রীষ্মকালে । রঙিন আলোর খেলা ও জলপ্রপাতের গিরি খাদে স্রোতধারার মধ্যে জাহাজে ভ্রমণ এক বিস্ময় । এতো দেখি প্রায়শ । কিন্তু নিউইয়র্ক দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলাম অনেকদিন ধরে । ২০১৯ সালে জাতিসংঘের অধিবেশন সংবাদ কাভার করতে গিয়েছিলাম ।

সেবার পেশাগত কাজের জন্য কোথাও দেখা হয়নি । তাই গত ১জুলাই থেকে ৩জুলাই২০২২, নিউইয়র্ক ঘুরে এসেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক এর হাডসান নদীতে ৪ ঘন্টার নৌবিহার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। যদিও ৫০০বছরের ঐতিহ্য নিয়ে গড়ে ওঠা এ মহানগর এত কম সময়ে দেখা সম্ভব নয়। ৩ জুলাই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক নিউইয়র্কের হাডসান নদীতে নৌবিহার আয়োজন করে । ১জুলাই ছিল কানাডার স্বাধীনতা দিবস। আবার ৪ জুলাই যুক্তরাস্ট্রের। এরকম অবস্থায় তিনদিনের ছুটি ছিল উভয় দেশে । তাই বিমান, ট্রেন ,বাস সব টিকেট ছিল দুষ্প্রাপ্য। এটা বাংলাদেশের ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ,বরিশাল কিংবা অন্য শহরে যাবার মত বিষয়।

তবে দূরত্ব হিসেবে রাস্তার ব্যবধান টরন্টো নিউইয়র্ক বেশী। টরন্টো থেকে অনলাইনে ট্রেলওয়েস ও গ্রেহাউন্ড বাসের টিকেট অগ্রিম কেটে রেখেছিলাম। দিবারাত্রি জেগে থাকা দুই শহর। মায়াবী তো বটে। টরন্টো ত্যাগের সময় ছিল বিকেল ৮টা। তখনও সূর্য পশ্চিম গগনে। পিয়ারসন বিমান বন্দর, হ্যামিল্টন, বার্লিংটন, নায়াগ্রা মৈত্রী সেতুর নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকনের মধ্যে যুক্তরাস্ট্রের সীমান্ত চেক পোস্টে এসে বাস থামলো । তখন সন্ধ্যা । ইমিগ্রেশন চেকে পাসপোর্ট ও করোনা টিকার সামপ্রতিক চিত্র দেখে কর্তব্যরত অফিসার জানতে চাইলো ,ভ্রমণের কারণ । জবাব দিলাম , বেড়াতে যাচ্ছি । থাকবে কোথায় , জ্যামাইকা । একেবারে সাদামাটা বিষয় । অত:পর বাস যাত্রীদেও নিয়ে নিউইয়র্কের বাফেলো এসে থামলো । কফি ব্রেক শেষে আবার ছুটে চলে ট্রেইলওয়েস বাস । আধুনিক বাসে ঘুম নয়, জেগে আছে সবাই । ওয়াইফাই সুবিধা নিয়ে মোবাইলে বুদ হয়ে ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবে ছবি দেখা কিংবা পছন্দের গান শুনছেন । পত্রিকা ,বই পড়ছেন কেউ কেউ ।

আলো আধাঁরির মধ্যে দীর্ঘকায় কালো মানুষ হলেও স্মার্ট ড্রাইভার রায়ান বললেন , আমরা সাইকোস পৌছানোর পর ৩০ মিনিট বিরতি । সকলে খাবার ও পানীয় ,কফি খেয়ে বাসে আসবেন । বলেই হাসি…..। বাসে আমরা কোন খাবার দিতে না পারার জন্য দু:খিত । দীর্ঘ ৮/১০ ঘন্টা ভ্রমণে এটা আমেরিকান সংস্কৃতি ।অথচ ঢাকা চট্টগ্রাম, সিলেট , বরিশাল ,দিনাজপুর সহ সব আধুনিক বাসে খাবার ও পানি দেয়া হয় ।

সাইকোস বাস বিরতিতে নেমে প্রাকৃতিক দৃশ্য ও রাতের জেগে থাকা শহর দেখে আবার উঠে পড়ি । এবার আকাশে উকিঁ দিতে দেখি ভোরের বর্ণচ্ছটা । জামাইকা থেকে বন্ধু ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক এর সভাপতি ,সহপাঠী মাহমুদ আহমেদ ফোন করে জানতে চাইলো ওয়াশিংটন ব্রিজ অতিক্রম করেছি কি না । বললাম দেখা যাচ্ছে । বিশ্বদ্যিালয় হকি দলে ১৯৭৫ -১৯৮০ একসঙ্গে খেলেছি। তদুপরি সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহমুদ ফজরের নামাজ শেষ করে ।

ভোরে তার কালো রঙের কিয়া গাড়ি নিয়ে নিউইয়র্কের ম্যানহাটান পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালের ‘ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা ’অফিসের সামনে চলে আসে সকাল সাড়ে ৭টায় । আমি পাতাল থেকে ওপরে উঠে রোড ৮৪০ ,স্ট্রিট ৪০’র অপর প্রান্তে ২০ বছর পর দেখলেও মাহমুদকে ঠিকই চিনে ফেলি । ও আর দেরি করেনি ,বুকে জড়িয়ে ধরে বলে ,কতদিন পর তোমাকে দেখলাম । আবেগ সামলে নিয়ে দ্রুত গড়িতে উঠে পড়ি । এরপর বললাম ,তুমি টাইমস স্কোয়ার , জাতিসংঘ ভবন হয়ে যাবে । আবার আসার সুযোগ হয়ত পাব না ।

ম্যানহাটানের রাস্তায় একদিকে চলাচল । তাই মাহমুদ প্রথমে বিখ্যাত ‘টাইমস স্কোয়ার ’ গিয়ে গাড়ি পার্ক করে ।সবসময় অন্যদের ছবি তুললেও ,এবার নিজেদের ছবি তুললাম ।এরপর জাতিসংঘ ভবনের সামনে ছবি তুলে মাহমুদের জামাইকার বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে চললাম । কুইনস ব্রিজের ওপর দিয়ে ঐতিহ্যবাহি হাডসান নদীর অতিক্রম করে দ্রুত বেরেয়ার রোড জামাইকা, মাহমুদের বাড়িতে পৌছে যাই ।ছুটির দিন হওয়ায় দিনরাত জেগে থাকা মায়াবী নিউইয়র্কের রাস্তায় তখন গাড়ির কিউ চোখে পড়েনি ।তবে পরিকল্পিত ম্যানহাটানজুড়ে বিশ্বের সেরা কর্পোরেট কার্যালয় ,টাইমস স্কোয়ার , জাতিসংঘসহ ভবনগুলো যেন আকাশ ছুঁয়েছে । ডিজিটাল বিগগাপনের রঙিন ডিসপ্লে দেখে মনে হচ্ছিল দিনরাত জেগে আছে মায়াবী মহানগর নিউইয়র্ক ।

অত:পর স্নান শেষে সকালের নাস্তা খেয়ে আমার শোবার ঘর দেখিয়ে মাহমুদ লেগে পড়ে দুপুরের খাবার তৈরির কাজে । ১২টার পর উঠে দেখি নৌবিহার কমিটি আহবায়ক বিষ্ণু গোপ মাহমুদের বাসায় । পরদিনের আয়োজন নিয়ে আলোচনা শেষে নির্ধরিত কাজে চলে সে চলে যায়। আমেরিকায় দীর্ঘকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন আমাদের শিক্ষকঅধ্যাপক ড: মিজানুর রহমান মিয়া , ড: আশরাফ , ড: শফিকুর রহমান সহ সহপাঠি অধ্যাপক জাহাঙ্গীর শাহনেওয়াজ ডিকেন্স ,ড: জমির চৌধুরি ,সেকান্দার চৌধুরি , আইনুন নাহার দিপ সহ এলামনাই সাধারন সম্পাদক এ এস এম ফারুক ইকবাল সহ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি ।

এরপর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার সাজ্জাদ হোসেন সবুজ , সঙ্গীত শিক্ষক ড: তপন বৈদ্য ,সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান ,নাজমুল আহসান, শহীদুল ইসলাম বাচ্চু সহ শুভাকাংখিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি । সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোটেল মেরিয়টের অনুষ্ঠানে যোগ দেবার পর জ্যাকসান হাইটস বাঙালি এলাকায় গিয়ে শুভাকাংখিদের সঙ্গে মধ্যরাত অবধি কথা বলে ফিরে আসি জামাইকা ।

হাডসান নদীতে নৌবিহার ৪ ঘন্টা নিউইয়র্ক শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া হাডসান নদীটি নিউ জার্সির সঙ্গে যুক্ত ।উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত নদীটি ম্যানহাটান ও কুইনসের সংযোগ ঘটিয়েছে । এর ব্যাপ্তি ৩৪০০০ কিলোমিটার । ৩১৫ মাইল । লেক টিয়ার যার উৎসস্থল । জর্জ ওয়াশিংটন ও কুইনস বোরো ব্রীজ ,তলদেশে কুইনস বোরো টানেল, মিলে সড়ক , রেল চলাচলে নদীটি গুরুত্বপূর্ণ । ম্যানহাটান থেকে নিউ জার্সি গমনে টানেল ব্যবহার করা যায় । যদিও যানজট এড়াতে জিপিএস সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে । তদুপরি ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি ’র অবস্থান নদীর মাঝে (এলিস আইল্যান্ড) হওয়ায় পুরো এলাকা বিশ্বের অন্যতম পর্যটনের জন্য আকর্ষনীয় স্থান ।

৪জুলাই ,১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হবার পর ১৮৭৬ সালে এটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় ।শেষ হয় ২৮ অক্টোবর ১৮৮৬ । ৩০৫ ফুট উচু এ স্তম্ভের নকশা করেন ফ্রেডরিক বার্থলদি । তামা ও ইসপাতের সংমিশ্রণে এটা নির্মিত । সবই আনা হয় ফ্রান্স থেকে । কাদামাটির রং বদলে এখন করা হয়েছে সবুজাভ । তৈরি হয়েছে জাদুঘর । এখানে যেতে হয় ক্রুজ জাহাজে চড়ে । জনপ্রতি ভাড়া ৬০ – ৮০ ডলার । ৩ জুলাই বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৯টা স্কাইলাইন প্রিন্সেস ক্রুজ শিপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক এর নৌবিহার ছিল। হাডসান নদীতে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এর প্রথম নৌবিহার । লাগোর্ডিয়া বিমান বন্দর সংলগ্ন ওয়ার্লড ফেয়ার মেরিনা ঘাট হতে যাত্রা শুরু করে উত্তর থেকে দক্ষিণে ‘স্টাচু অব লিবার্টি’ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসে ক্রুজ শিপ । নদীতে ঢেউ তুলে স্পীড বোট ছুটে যাচ্ছিল ।

আমাদের জাহাজের দুই তলায় তিন শতাধিক চবিয়ান সদস্য ও পরিবার তখন আনন্দলোকে মংগালোকে সত্য সুন্দর .. গানে মেতে উঠেছে।

আরও পড়ুনঃ অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দেশ গড়তে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান

সবাই আসন গ্রহনের পর সংগঠনের ৩০ বছরের ইতিহাস উপস্থাপন ও স্বাগত বক্তৃতা, উপদেষ্টাদের পরিচয়পর্ব ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখা পড়া ,সহপাঠি, সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক উৎসব, খেলা , রাজনীতি , ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক, ভালবাসা , শাটল ট্রেনের আনন্দ অবগাহন, হলজীবন সব বিষয়ে সৃতিচারনের সময় অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন । তবে নদীর দুই তীরের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী , ওয়াশিংটন ব্রীজ ,কুইনস ব্রীজ ,জাতিসংঘ ভবন , স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখে চোখ ফেরানো যায়না । ছবি তুলতে মেতে ওঠেন সবাই । এরমধ্যে সন্ধ্যা ৭টায় শুরু কবিতা আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠান । মাইকে ঘোষণা আসে নৈশ ভোজের । সবজি ,ডাল মুরগী ,গরুর মাংস , ফিরনি ,কোমল পানীয় , চা মিলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে গানে মেতে ওঠেন সবাই । সান্ধ্যকালীন হাডসান নদীর দুই তীরে তখন রংবেরংয়ের আলো জ্বলে ওঠায় সকল ব্রীজ,লাগোর্ডিয়া বিমান বন্দরে বিমান ওঠানামা মিলে বর্ণিল পরিবেশ তৈরি হয় । এর মধ্যে গান চলছে , চল না ঘুরে আসি অজানাতে .. আবার এল যে সন্ধ্যা .. শুধু দু’জনে ..।

স্কাইলাইন প্রিন্সেস ততক্ষণে ওয়ার্লড ফেয়ার মেরিনা ঘাটে ফিরে আসে । ঘাট থেকেই মাহমুদ আমাকে নিয়ে গাড়িতে করে ছুটে যায় ম্যানহাটান পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে । রাত তখন ১০টা । নীচে নেমে গ্রেহাউন্ড বাসে উঠে বসলাম । টরন্টো, কানাডার উদ্দেশ্যে বাস যাত্রা করলো । মাথায় তখন দুইদিন .. মায়াবী নিউইয়র্কে ।

Spread the love
Link Copied !!