চোখ সত্যিই তার মনের কথা বলতো


তা র কা জ গ ৎ
প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২, ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ / ২৯
চোখ সত্যিই তার মনের কথা বলতো

শিল্প সংস্কৃতির কোন সীমানা প্রাচীর নেই, দেশ নেই, ভাষা নেই। নেই এর জাতি কূল ভেদ। সুর, তাল, লয় , ছন্দ আর‌ও বেশি একাট্টা করে।
জোয়ান বেজের হান্ড্রেড মাইলস যেমন কিশোর আর তারুণ্যের মাঝামাঝি বয়সে ঘোরে ফেলেছিল, সেখানে কোন সীমানা ছিল না। আবার বব মার্লির নো স্যাকরিফাইস, এলটন জনের নো ওম্যান নো ক্রাই কোনটির কথা বলবো। মনে হয়নি দূরের কেউ গাইছে। ডুবে থাকতাম।
ছোট বেলার সকালটায় সন্ধ্যা, হেমন্ত, গীতাদত্ত, মান্না দের রাজত্ব ছিল আমার বড় হয়ে ওঠা বাড়িটায়।
এর মধ্যেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানের বিশেষ সেশন চলতো টেপ রেকর্ডারে। আর বাকি সময়ে বাংলা ভাষার গানে ভারতীয় বাংলা গান আমাদের ঘরে খুঁটি হয়েই ছিল।
১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চের আগে আমাদের বাড়িতে রিহার্সেল হতো। ‘ জয় বাংলা বাংলার জয়’ এই গানটি দিয়ে শুরু হতো কোরাস। কে গীতিকার, কে সুর করেছে খোঁজ ছিলনা। পাবলিক হলে যখন আমাদের শো হতো এই গানের সাথে সাথে পুরো পৃথিবী যেন গেয়ে উঠতো- ‘ কোটি প্রান একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়‌’।
রিহার্সেলের সময় আমার নানু মন দিয়ে শুনতেন। আর নীরবে তার চোখ দিয়ে ঝরতো চোখের পানি। যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের কথা বলতেন। ৭১ এর শহীদদের কথা বলতেন‌। স্বধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা বলতেন।
জন্মসূত্রে পাওয়া আমার সৌভাগ্যের কথা বলি। প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই আমি জয় বাংলা বাংলার জয় গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার এর দেখা পেয়েছি। আমার মেজো মামা চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামানের বাসায়। বিদেশী মানুষ নাকি। বাংলায় কথা বললো। আমি জয় বাংলা বাংলার জয় তাকে গাইয়ে শোনালাম। পকেট থেকে বের করে ৫০ টাকা দিলেন। আমি তো নেবো না। কিন্তু সবাই বললেন এটা রেওয়াজ। শিল্পীর সম্মানি। এটুকুই।
তারপর ধীরে ধীরে আমার মধ্যেও জাতীয়তাবাদ একটু যেনো জায়গা করে নিল। কৈশোরের প্রান্ত থেকে একটু রোমান্টিক গানের দিকে ঝোঁক তৈরি হলো কাজিনদের গান শোনা থেকে। অবশ্য এর মধ্যে রেডিও হয়ে উঠলো নিত্যসঙ্গী। আর গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নাম শুনলেই কানটা আর‌ও সতর্ক হয়ে উঠত। ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়’ – গানটি কত হাজার বার যে শুনেছি। ভারতীয় বাংলা গানের মধ্যে বার বার ট্যাপে এই গান শুনতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল এই গানটা আমাদের শিশু-কিশোরদের মুখে মুখে ছিল।
যাই হোক এরপর মানসী সিনেমার গান ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘ নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, গোলাপী এখন ট্রেনে ছবির গান ‘আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিষ্টার – এটা তো আমাদের পারিবারিক আড্ডার একটা জনপ্রিয় গান হয়ে উঠলো।
যাইহোক আমার জাতীয়তাবাদ খোঁজার কথা বলি। বাংলা ভাষার গানে আলোচনায় যখন ভারতীয় বাংলা গানের প্রচন্ড প্রভাব, তখন আমি অবচেতন মনেই আমার দেশের গানগুলো খুজতাম। আর আমার এই সূত্রধর ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুর খবর পেলাম। আমার কাছে একটা তীক্ষ্ণো আলোর কণা চোখে ভাসলো। সেই আলোটায় আমি মাজহারুল আনোয়ারের চোখের মনি দেখতে পেলাম।
কিংবদন্তি বিদায় নিয়েছেন। এমন প্রতিভাবান মানুষ কত জনমে পাওয়া যাবে জানি না। এটা তো সত্য বাংলাদেশ এমন মানুষ পেয়েছে। কর্মব্যস্ততার কারণে তার মত নিখুঁত করে ছোট্ট স্মৃতিচারণটাও আমাদের দিয়ে হয় না।
অথচ এই কিংবদন্তি জীবনে বিশ হাজারেরও বেশি গান উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে বিবিসির সেরা বাংলা গানের যদি জরিপে ২০ টি গানের মধ্যে তিনটি এই আলোর দিশারী। আমার মধ্যে বাংলা গানের সবগুলো দিক দেশপ্রেম, মারফতি, জাগরণ, মুক্তিযুদ্ধ এবং কোমল মিষ্টি প্রেমের আধুনিক বাংলা গান অনুরণনে ভূমিকা রেখেছেন আমি তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। একাধারে তিনি ছিলেন গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক।( সিনিয়র সাংবাদিক দেশ রূপান্তরয়ে কর্মরত উম্মুল-ওয়ারা সুইটির ফেসবুকে লেখা সদ্য প্রয়াত গুণীজন গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ )

Spread the love
Link Copied !!